আজ তারিখ কত? কিংবা, আজকে কি বার? অথবা, এখন কোন মাস বা সাল চলছে? এ ধরনের কোনো প্রশ্ন যখন আমাদের মাথায় আসে তখন একটি উত্তরের কথাই আমাদের মনে পড়ে। তা হচ্ছে – ক্যালেন্ডার। ক্যালেন্ডার আমাদের নিত্যদিনের একটি অপরিহার্য উপাদান। মোবাইলে হোক, ল্যাপটপে হোক, দেয়ালে টাঙ্গানো হোক কিংবা টেবিলের উপরে রাখা হোক ক্যালেন্ডারের প্রয়োজনীয়তা আমাদের প্রতিদিনই অনুভূত হয়।
কোনো বিশেষ দিন মনে রাখতে, কোনো কিছুর আয়োজনে দিন তারিখ ঠিক করা সহ নানা কাজে ক্যালেন্ডার ব্যবহারের জুড়ি নেই।
ক্যালেন্ডার দিনগুলি সংগঠিত করার একটি ব্যবস্থা। এটি সময়কাল, সাধারণত দিন, সপ্তাহ, মাস এবং বছর নামকরণ করে সম্পন্ন হয়। আমরা সচরাচর যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি তা হচ্ছে ইংরেজি ক্যালেন্ডার। এই ক্যালেন্ডার শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে পঞ্জিকা বা দিনপঞ্জিকা। ক্যালেন্ডার শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ যেমন আছে, তেমনি বাংলা ক্যালেন্ডার বা বাংলা পঞ্জিকাও নিশ্চয়ই আছে।
বাংলা পঞ্জিকা
বাংলা পঞ্জিকা হলো ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা অঞ্চলে ব্যবহৃত একটি লুনি-সৌর (সূর্য এবং চাঁদের প্রভাব সম্পর্কিত) ক্যালেন্ডার। এই বাংলা পঞ্জিকার সংশোধিত সংস্করণ বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা ক্যালেন্ডারের সংশোধিত সংস্করণ গৃহীত হয়েছিল। তবে এখনও বাংলা ক্যালেন্ডারের পূর্ববর্তী সংস্করণটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামে অনুসরণ করা হয়। বাংলা সালকে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন বলা হয়ে থাকে। ইংরেজি বছরের মতো বঙ্গাব্দেও মোট ১২ মাস। এগুলো হল বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র। আকাশে রাশি মণ্ডলীতে সূর্যের অবস্থানের ভিত্তিতে বঙ্গাব্দের মাসের হিসাব হয়ে থাকে। যেমন যে সময় সূর্য মেষ রাশিতে থাকে সে মাসের নাম বৈশাখ। বৈশাখ মাসের ১ তারিখ দিয়ে বাংলা সনের শুরু।
বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কে ২টি মত চালু আছে। প্রথম মত অনুযায়ী – প্রাচীন বঙ্গদেশের (গৌড়) রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে শশাঙ্ক বঙ্গদেশের রাজচক্রবর্তী রাজা ছিলেন। আধুনিক বঙ্গ, বিহার এলাকা তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ অনুমান করা হয় যে, জুলীয় বর্ষপঞ্জির বৃহস্পতিবার ১৮ মার্চ ৫৯৪ এবং গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির শনিবার ২০ মার্চ ৫৯৪ বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল।
দ্বিতীয় মত অনুসারে, ইসলামী শাসনামলে হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে সকল কাজকর্ম পরিচালিত হত। মূল হিজরী পঞ্জিকা চান্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল। চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরের চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ সৌর বৎসরে ৩৬৫ দিন, আর চান্দ্র বৎসর ৩৫৪ দিন। এ কারণে চান্দ্র বৎসরে ঋতু গুলি ঠিক থাকে না। আর বঙ্গদেশে চাষাবাদ ও এজাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। এজন্য মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে প্রচলিত হিজরী চান্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরী চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌর বর্ষপঞ্জিতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ফতুল্লাহ শিরাজীর সুপারিশে পারস্যে প্রচলিত ফারসি বর্ষপঞ্জির অনুকরণে ৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর হিজরী সৌর বর্ষপঞ্জির প্রচলন করেন। তবে তিনি ঊনত্রিশ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহণের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরী সালের মহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখককে নববর্ষ ধরা হয়।
পুরাতন বাংলা বর্ষপঞ্জি
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, সৌর-মাস নির্ধারিত হয় সূর্যের গতিপথের উপর ভিত্তি করে। সূর্যের ভিন্ন অবস্থান নির্ণয় করা হয় আকাশের অন্যান্য নক্ষত্রের বিচারে। প্রাচীন কালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যের বার্ষিক অবস্থান অনুসারে আকাশকে ১২টি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এর একটি ভাগকে তারা নাম দিয়েছিলেন রাশি। আর ১২টি রাশির সমন্বয়ে যে পূর্ণ আবর্তন চক্র সম্পন্ন হয়, তার নাম দেওয়া হয়েছে রাশিচক্র। এই রাশিগুলোর নাম হল– মেষ রাশি, বৃষ রাশি, মিথুন রাশি, কর্কট রাশি, সিংহ রাশি, কন্যা রাশি, তুলা রাশি, বৃশ্চিক রাশি, ধনু রাশি, মকর রাশি, কুম্ভ রাশি ও মীন রাশি। সূর্যের বার্ষিক অবস্থানের বিচারে, সূর্য কোনো না কোন রাশির ভিতরে অবস্থান করে। এই বিচারে সূর্য পরিক্রমা অনুসারে, সূর্য যখন একটি রাশি থেকে অন্য রাশিতে যায়, তখন তাকে সংক্রান্তি বলা হয়। এই বিচারে এক বছরে ১২টি সংক্রান্তি পাওয়া যায়। একেকটি সংক্রান্তিকে একেকটি মাসের শেষ দিন হিসেবে গণ্য করা হয়।
যেদিন রাত্রি ১২টার মধ্যে সূর্য্য ০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে প্রবেশ করে তার পরদিনই ১লা বৈশাখ (পহেলা বৈশাখ) হয়। যেদিন রাত্রি ১২টার মধ্যে সংক্রান্তি হয় তার পরদিনই মাসের প্রথম দিন। মূলত একটি সংক্রান্তির পরের দিন থেকে অপর সংক্রান্ত পর্যন্ত সময়কে এক সৌর মাস বলা হয়। লক্ষ্য করা যায় সূর্য পরিক্রমণ অনুসারে সূর্য প্রতিটি রাশি অতিক্রম করতে একই সময় নেয় না। এক্ষেত্রে মাসভেদে সূর্যের একেকটি রাশি অতিক্রম করতে সময় লাগতে পারে, ২৯, ৩০, ৩১ বা ৩২ দিন। সেই কারণে প্রতি বছর বিভিন্ন মাসের দিন সংখ্যা সমান হয় না। এই সনাতন বর্ষপঞ্জি অনুসারে বছর ঋতুভিত্তিক থাকে না। একেকটি মাস ক্রমশঃ মূল ঋতু থেকে পিছিয়ে যেতে থাকে।
বাংলা বর্ষপঞ্জির সংস্কার
১৯৫০-এর দশকে প্রখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহা কে প্রধান করে ভারত সরকার ভারতবর্ষের দিনপঞ্জিকা সংস্কারের কমিটি গঠন করে। মেঘনাদ সাহা কমিটি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্রচলিত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিকার আমূল পরিবর্তন করে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তিতে প্রস্তাব পেশ করেন। এই কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী—
- বৈশাখ থেকে ভাদ্র— এই পাঁচ মাস ৩১ দিন গণনা করা হবে।
- আশ্বিন থেকে চৈত্র— এই সাত মাস ৩০ দিন গণনা করা হবে।
- অধিবর্ষে চৈত্র মাস ৩১ দিন গণনা করা হবে।
কিন্তু সাহা কমিটির প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়ন করা হয় না। বাংলাদেশ কয়েকবার বাংলা পঞ্জিকা সংশোধন করে। ১৯৬৩ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার’ নামে বাংলা একাডেমি কমিটি গঠন করে যা ‘শহীদুল্লাহ কমিটি’ নামে পরিচিত হয়। এই কমিটি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সুপারিশকে প্রাধান্য দিয়ে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে। এই কমিটি আধুনিক গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি রীতি অনুসারে রাত ১২টা থেকে দিনের সূচনা করার অর্থাৎ তারিখ পরিবর্তনের প্রস্তাব দেয়। প্রচলিত মাপে সূর্যোদয়ে দিনের শুরু অর্থাৎ তারিখ পরিবর্তিত হতো।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে শহীদুল্লাহ কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে এর ভিত্তিতে বাংলা দিনপঞ্জিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এরপরও কিছু সমস্যা দেখা দেয়। বাংলা বর্ষপঞ্জিকাকে আরও বিজ্ঞান ভিত্তিক করার জন্য ১৯৯৫ সালের ২৬ জুলাই তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হারুন-উর-রশিদকে প্রধান করে পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, ভাষা, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এই কমিটি মেঘনাদ সাহা ও শহীদুল্লাহ কমিটির মূল সুপারিশের নিরিখে ২০টি সুপারিশ পেশ করে। এর উল্লেখযোগ্য ছিল চৈত্র মাসের পরিবর্তে ফাল্গুনকে অধিবর্ষের মাস হিসেবে নির্ধারণ করা। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিতে যে বছর ফেব্রুয়ারি মাস অধিবর্ষ হবে, সেই বছর বাংলা বর্ষপঞ্জিকায় ফাল্গুন মাস ৩০ দিনের পরিবর্তে হবে ৩১ দিন। তারপরও বাংলা বর্ষপঞ্জিতে বিদ্যমান কিছু অসামঞ্জস্য দূর করে পুরোপুরি বিজ্ঞান ভিত্তিক এবং জাতীয় দিবসগুলোকে মূলানুগ করতে ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানকে সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক অজয় রায়, পদার্থবিজ্ঞানী জামিল চৌধুরী, অধ্যাপক আলী আসগর, একাডেমির পরিচালক অপরেশ কুমার ব্যানার্জী প্রমুখ ব্যক্তিদের নিয়ে তৃতীয়বার বর্ষপঞ্জি সংস্কার কমিটি কমিটি করা হয়। এই কমিটি প্রধানত বিশেষ দিনগুলোতে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিকে ও বাংলা বর্ষপঞ্জিকে মূলানুগ করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের সুপারিশ পেশ করে। এই কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী—
- বৈশাখ থেকে আশ্বিন— এই ছয় মাস ৩১ দিন গণনা করা হবে।
- কার্তিক থেকে মাঘ এবং চৈত্র— এই পাঁচ মাস ৩০ দিন গণনা করা হবে।
- ফাল্গুন মাস ২৯ দিনে গণনা করা হবে।
খ্রিষ্টাব্দের অনুগামী বছরে ফাল্গুন মাসে বঙ্গাব্দে অধিবর্ষ হবে অর্থাৎ যে খ্রিস্টাব্দে অধিবর্ষ হবে সেই বাংলা বছরে ফাল্গুন মাস ৩০ দিনে গণনা করা হবে।
বাংলাদেশে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে শামসুজ্জামান খান কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সরকারি বর্ষপঞ্জি তৈরি করা হয়। বর্তমানে সরকারি ভাবে এই বর্ষপঞ্জিই চালু আছে।
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট